এবার একটু দীপের বর্তমান স্টাডি লাইফের কথা বলা যাক । দীপ বর্তমানে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছিল । মাধ্যমিকে ডিস্ট্রিক্ট ফার্স্ট হয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছিল সে, দরিদ্র মেধাবী ছাত্র হওয়ার দরুন সরকার ও স্কুলের শিক্ষক মহাশয়দের সহায়তায় তার হায়ার স্টাডি করতে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি সেভাবে । যথাযথভাবে উচ্চমাধ্যমিক এও ভালো ফলাফল করেছিল । স্কুলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল তো বটেই, ব্লকের স্কুলগুলির মধ্যেও প্রথম স্থান অধিকার করেছিল দীপ । এরপর অল ইন্ডিয়া জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সাম দিয়ে ভালো র্যাঙ্ক করে খড়্গপুর আইআইটি তে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছিল । বর্তমানে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল দীপ । বয়স কুড়ি ছুঁই ছুঁই । তার মধ্যে এইসব হয়ে গেল ।. যাই হোক এবার ঘটনায় আসা যাক ।
আজ ষষ্ঠী । বেলা ১১ঃ৩০ বাজছে । গ্রামে একটাই দুর্গাপূজা একটাই বড় মেলা, তাই সবকিছুর তোড়জোড়, ষষ্ঠী পূজার আরম্ভর প্রস্তুতি একেবারে জোর কদমে । ঢাকীদের ঢাকের আওয়াজ, মেলা প্রাঙ্গণে বাচ্চাদের ছোটা ছুটি, ক্যাপ ফাটানোর আওয়াজ এইসবেই মেতে উঠেছিল গ্রামটি । অনল বাবুর বাড়িতেও পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছিল জোড় কদমে, যতই দারিদ্রতা থাক দুর্গাপূজো বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব বলে কথা আনন্দ মনে প্রাণে সর্বদাই, সর্বাঙ্গীণ । ” কিরে ওঠ আর কত বেলা করে উঠবি? বেলা 1130 বাজছে এরপর তো পুজো শুরু হয়ে যাবে কখন যাব বলতো পূজা দিতে কি হলো রে বাবু? ওঠ. এরপর কখন উঠবি আর কখন খাবি স্নান করবি আর কখনই বা যাবি ঘুরতে? ওঠ রে.” দিপালী দেবী বারবার ডাকাডাকি করার পরেও যখন দরজার ভেতর থেকে কোন সাড়া আসছিল না । তখন দিপালী দেবী অনল বাবুকে ডাকাডাকি করেন,” কি হলো গো একটু দেখো না ছেলেটা কেন সাড়া দিচ্ছে না, কোনদিনও তো এরকম করে না ।
আজ কেন এরকম করছে? একটু দেখো না, একটু ডাকো না ওকে, কি হলো বলতো ছেলেটার?”. এরপর অনলবাবুও দীপকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করেন । কিন্তু কোন উত্তর আসেনি ভেতর থেকে । ওদের চেঁচামেচি শুনে পাড়া- প্রতিবেশীর কিছু মানুষ ছুটে আসেন । ব্যাপারটা ঠিক লাগছিল না দেখে দিপালী দেবী অনল বাবুকে দরজাটা ভাঙতে বলেন । অনল বাবু ও কিছু প্রতিবেশীর সহায়তায় দরজাটা ভাঙার পর, তারপর সেই বীভৎস দৃশ্য এর সম্মুখীন । ততক্ষণে গ্রামের লোকে পুলিশে খবর দিয়েছে । পুলিশ এসে উপস্থিত হয়ে গেছে । দীপের সবথেকেপ্রিয় লাল পাঞ্জাবি ও তার সাথে ম্যাচিং করা প্যান্ট পড়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলানো দড়িটি তার গলায় পেচিয়ে, আর সে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে । এটা দেখার জন্য বোধহয় কেউই প্রস্তুত ছিল না, তাই সবাই আঁতকে উঠছেন আর তার মা দিপালী দেবী বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন ।
প্রতিবেশীদের চোখে মুখে কৌতুহল আক্ষেপ বিষাদের ছায়া, তারা যে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না ফুটফুটে এই ছেলেটার অকাল মৃত্যু । পুলিশ দেহটি নামিয়ে নারী চেপে দেখে আর বুঝতে পারে সে আর নেই, । পঞ্চমী থেকে কলেজের ছুটি পড়ায় পঞ্চমী সন্ধ্যায় বাড়ি এসে পৌঁছায় দীপ । রাতে ডিনার করার সময় বাবা মায়ের সাথে নানা রকম প্ল্যানিং করছিল পুজোর কোন দিন কোথায় যাওয়া যায় সেই নিয়ে । কলেজ থেকে আসার সময় সে তার মায়ের জন্য একটি শাড়ি ও বাবার জন্য একটি শার্ট ও কিনে এনেছিল । আর নিজের জন্য এনেছিল সেই লাল পাঞ্জাবি । তবে সেসব পরে ছেলের সাথে আর পুজো কাটানো হলো না । পুজোর প্ল্যানিং, পুজোর আনন্দ সব অপূর্ণ রয়ে গেল দিপালী দেবী ও অনল বাবুর । চারিদিকে যখন পুজো প্যান্ডেলে মাইকে গান বাজছে, বাচ্চাদের ছোটাছুটি, খেলাধুলা, ক্যাপ ফাটানোর আওয়াজ, তখন সোনারপুর গ্রামের এক মায়ের সদ্য কোল খালি হয়ে যাওয়ার বুক ফাটা কান্না আর শোকের আর্তনাদ ।
বডিটা মহকুমা হাসপাতালে পাঠাতে হবে অনল বাবু, অস্বাভাবিক মৃত্যু তাই ময়নাতদন্ত করা জরুরী, তবে আপনাদের যদি কোন সন্দেহ থাকে তাহলে একটা লিখিত অভিযোগ করে যাবেন তদন্ত শুরু করা হবে তারপর ।” জানিয়ে দিলেন সোনারপুর থানার ওসি সুরোজ স্যান্যাল । তারপরে পুলিশ বডিটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলে এবং পাঠিয়ে দেয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে । অ্যাম্বুলেন্সের পিছু পিছু গোলাপ ও রজনীগন্ধায় সাজানো শববাহী গাড়িটিও যাচ্ছে । সুরোজ বাবু, দিপালী দেবী ও অনল বাবুকে খানিক সান্ত্বনা দিয়ে প্রিজন ভ্যান নিয়ে চলে যান । নিজের ছেলের এই চলে যাওয়া সহ্য করতে না পেরে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলায়, স্বাস্থ্যের অবনতির লক্ষণ দেখে প্রতিবেশীরা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায় । আর অনল বাবু পাথর হয়ে সেখানেই বসে রইলেন ।