এসবের মাঝে দেখেছেন দীপের দৈহিক গঠনের বর্ণনাটাই দেওয়া হয়নি তাহলে চিনবেন কিভাবে বলুন। শুধু তার ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি, তাহলে শুনুন………. উচ্চতা 6 ফুট 2 ইঞ্চি হবে, গায়ের রং ফর্সা, মুখে ফ্রেশ সেভিংস, চুল বেশ ছোট করে কাটা। মুখের বাঁদিকের এক পাশের গালে একটি মানানসই ছোট্ট কালো তিল, সুঠাম চেহারা তবে ওই একটু রোগা গোছের আর কি। তবে বাঁ হাতের তালুতে সেই ক্ষতচিহ্নটি এখনো বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর সেন দেখে জানিয়ে দেন যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসতে অন্তত 24 ঘন্টা সময় লাগবে। থানার তরফ থেকে দীপের বাবা মাকে জানানো হয়েছে সেটি।
এদিকে দীপের মা গলা দিয়ে জল পর্যন্ত ঘিটছে না। দীপের বাবা ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না ঘটনাটি আর খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা । কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে যায় দীপের মায়ের,সারারাত জেগেই, দীপের স্মৃতিচারণা করেই কেটে গেল সারা রাতটা। সান্তনা দেওয়ার মতো পাশে ছিল পাশের বাড়ির দীপের এক কাকিমা ও জেঠিমা। আর ছিল দীপের মেজ মামা।
সত্যি অগ্নিদীপ নামটা যেন সার্থক হয়েও হলো না। তার প্রতিভা ,,তার ব্যক্তিত্ব অগ্নির মতো দীপ্ত হলেও জীবন কিন্তু প্রদীপের শিখার আলোর মতো জ্বলে দীপ্ত রইলনা। অদূরেই নিভে গেল।
দিপালী দেবী নিজেই তাদের একমাত্র সন্তানের নামটি অগ্নিদীপ দিয়েছিলেন জানেন। বাবা অনল মানে অগ্নি আর দিপালী দেবীর দীপ মানে প্রদীপ মিলিত করে রেখেছিলেন অগ্নিদীপ
এদিকে ২৪ ঘন্টা কেটে গিয়েছে । আজ সপ্তমী। গ্রামের পুরোহিত মহাশয় কলা বউকে নিয়ে গেলেন স্নান করাতে, সপ্তমীর পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে মেলা প্রাঙ্গণ ও প্যান্ডেল চত্বরে শুধু ঢাক ,শঙ্খ ও ঝাঁজ বাজছে, তাও পুজোর প্রয়োজন অনুসার। মাইক বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ সকলের প্রিয় দীপকে হারিয়ে গোটা গ্রাম শোকস্তব্ধ।
ময়না তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে প্রিজন ভ্যানে দীপেদের বাড়ি পৌঁছলেন সুরোজবাবু ও কয়েকজন কনস্টেবল। আর প্রিজন ভ্যানের পিছু পিছু সাইরেন বাজিয়ে আসছে সেই সাজানো শববাহী গাড়িটি। অদুরেই সেই ঢাকের আওয়াজ ও শঙ্খধ্বনি এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল।
ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছেছেন সোনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ বাকি শিক্ষকেরা ,পঞ্চায়েত প্রধান, বিডিও স্যার আর জমা হয়েছেন রিপোর্টারেরাও। দীপেদের বাড়ির উঠোনে।
হাসপাতাল থেকে গতকাল রাতেই ফিরেছেন দীপের মা । শেষবারের মতো শববাহী গাড়ি থেকে নামানো হলো দীপের দেহটি তাদের বাড়ির উঠোনে , ছেলেকে জড়িয়ে মা-বাবার বুক ফাটা কান্না ,আর্তনাদ চোখে দেখা যায় না । বেলা তখন বারোটা বেজে পনেরো মিনিট।
– “অনল বাবু যা যা নিয়ম ও কাজ আছে সেরে নিন ,দেহটি তাড়াতাড়ি সৎকার করতে হবে। বুঝতেই পারছেন অলরেডি টোয়েন্টি ফোর আওয়ার হয়ে গিয়েছে ডেড বডিটি,। এরপর আরো দেরি করলে প্রবলেম হয়ে যাবে।” – বললেন সোনারপুর থানার ওসি সুরোজ বাবু।
স্কুলের শিক্ষক মহাশয়রা সহ একে একে বিডিও স্যারসহ, পঞ্চায়েত প্রধান সবাই এই কৃতি ছাত্রের দেহটিতে শেষ সংবর্ধনা জানিয়ে দিলেন।
সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড় ও তাদের একাধিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না অনলবাবু ও দিপালী দেবী কেউই। তাই রিপোর্টারদের সামলাচ্ছেন বাকি পুলিশ কনস্টেবল রা। যাতে এক বিচ্ছিরি বিশৃঙ্খলার পরিবেশ না সৃষ্টি হয়।
– “আপনি কি বলতে চান এই ঘটনা সম্পর্কে?” -দীপের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয় কে প্রশ্ন করলেন এক মহিলা সাংবাদিক ।
দীপ ভীষণই মিশুকে ও সাহসী ছেলে।” -সাংবাদিকের উত্তর দিয়ে বললেন দীপের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়।
সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মীদের উদ্দেশ্যে উপস্থিত মানুষজন,সবাই চেচিয়ে বলে উঠল ‘আমরাও বিশ্বাস করি না যে দীপ আত্মহত্যা করেছে।’
-“আচ্ছা আমরা বুঝতে পারছি আপনারা শান্ত হোন, অগ্নিদীপের বাবা একটা লিখিত ডায়েরী করলেই আমরা এই ঘটনার তদন্ত শুরু করব।”- বললেন সুরোজ বাবু।
-“আপনি আপনার অফিসের কাজ ফেলে শত ব্যস্ততার মাঝেও এখানে এসেছেন আপনার কি মন্তব্য এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে?”-বিডিও স্যার কে প্রশ্ন করলেন এক পুরুষ সাংবাদিক।
মৃত দেহটির অবনতি লক্ষ্য করে ,শীঘ্র সৎকার কার্য সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেন ওসি সুরজ বাবু।
উঠান থেকে দীপের দেহটি তোলা হল । শববাহী গাড়িটি নিয়ে দীপের বাবা সহ কয়েকজন প্রতিবেশী সমেত ,রওনা দিলেন শ্মশানের উদ্দেশ্য ।
কিছু প্রতিবেশী রয়ে গেলেন দীপের মাকে সামলাতে ।ধীরে ধীরে ভিড় ফিকে হতে লাগলো। উঠানটি ফাঁকা হয়ে গেল একসময়। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। একতলা ঘরের দুটি কামরা, অন্ধকারে ক্রমশ নিমজ্জিত হতে লাগলো। তখনো তোবড়ানো সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত দড়ির কিছুটা অংশ রয়ে গিয়েছে।আর শোনা যাচ্ছে দীপের ঘর থেকে একটি ফোনের রিংটোনের আওয়াজ।