আহিল: কতদিন হয়ে গেল কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না । উফ লাইফ টা কেমন নিরামিষ নিরামিষ লাগছে। চল সবাই মিলে কোথাও থেকে একটা ঘুরে আসি ।
কি বলিস তোরা ?
কাব্য: কথাটা ঠিকই বলেছিস, কিন্তু কোথায় যাওয়া যায় বলতো?
আহিল: এবারে ভাবছি কোন গ্রাম এলাকার দিকে যাওয়া যাক।
শহরের ব্যস্ত কোলাহল পুর্ণ জীবন দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠেছি।
নিরব: হ্যাঁ, যাওয়াই যায় কিন্তু সেখানে থাকবো টা কোথায় সেখানে তো আর হোটেল পাওয়া যাবে না।
আহিল:আরে চাপ নিস কেনো টেন্ট নিয়ে যাব সাথে ছোট খাটো ক্যাম্পিং করা হয়ে যাবে।
ওদের কথাই আমার মন খুশিতে নেচে উঠলো।
আমি : কথাটা কিন্তু জোস বলেছিস। একইসাথে রোড ট্রিপ, ক্যাম্পিং, অ্যাডভেঞ্চার, আর প্রকৃতি আর কি লাগে। উফ আমার তো ভেবেই কি আনন্দ লাগছে।
মাহি: রাখতো তোর জোস!
এই মেয়ের শুধু ট্রাভেলের কথা শুনলেই হল, আরে বাবা রাতে অচেনা একটা জায়গায় ক্যাম্পিং করাটা কি ঠিক হবে??
আহিল: ওই শুরু হয়ে গেল মহারানীর। বলি তুই আমাদের বান্ধবী হলি কি করে বলতো? সাহসের বেলায় তো পুরাই ভজার মা।
আহিলের কথাই আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
আসুন পরিচয় পর্বে আসা যাক । আমি তানিয়া। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। আর এতক্ষণ যাদের সাথে কথা হচ্ছিল তারা হচ্ছে আমার বন্ধুরা। আহিল, কাব্য, নিরব আর মাহি। আমরা সবাই প্রকৃতি প্রেমি। মাঝেমাঝেই এখানে সেখানে হুটহাট বেড়িয়ে যায় প্রকৃতি বিলাস করতে।
যাই হোক মাহি কে অনেক কষ্টে রাজি করালাম যাবার জন্য।
নিরব: সব না হয় হল কিন্তু যাব টা কোথায়?
নিরবের কথাই আমরা ভাবতে শুরু করলাম কোথায় যাওয়া যায়।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, তোমরা রায়েরগঞ্জে যাচ্ছ না কেন?
পিছন থেকে কারোর আওয়াজ আসলে আমরা পেছনে ফিরে তাকালাম দেখলাম একটা বুড়ি মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সেই এ কথাটা বলেছে। আহিল তখন বলে উঠলো রায়েরগঞ্জ সেটা কোথায়? সেখানে কি বা এমন রয়েছে?
ওই মহিলাটি তখন বলে উঠলো রায়েরগঞ্জ পার্বত্য এলাকার মধ্যে অবস্থিত তার পাশ থেকে বয়ে যায় ছোট্ট একটি নদী তোমরা যাও তোমাদের অবশ্যই জায়গাটি ভালো লাগবে।
পাহাড়ি এলাকা আর নদীর কথা শুনে আমরা কেউ আর লোভ সামলাতে পারলাম না রাজি হয়ে গেলাম। তার কথায় মাহি তখন বলে উঠলো” আমাদের কি চা
যাওয়াটা ঠিক হবে ওই মহিলাকে আমরা চিনি না পর্যন্ত আমার যেন খুব অদ্ভুত লাগছে সবটা “
মাহির কথায় কেউ পাত্তা না দিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নিলাম কাল সকাল 7 টার সময় বেরিয়ে পড়বো, মাহির আর কি করার সেও রাজি হয়ে গেল। সাতটার সময় আমরা সবাই একসাথে জড়ো হয়ে রওনা দিলাম রায়েরগঞ্জের উদ্দেশ্যে । রাস্তাটা সত্যি অপরূপ দূরদূরান্ত পর্যন্ত মাঠ মাঝখানে রাস্তা কি অপরূপ দৃশ্য। সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম রায়েরগঞ্জে। ওই মহিলাটি এতটুকু কথা মিথ্যা বলেনি। সত্যিই জায়গাটি অপূর্ব হালকা উঁচু ঢিলার উপর একটি গ্রাম বসতি এবং সে গ্রামের থেকে কিছুটা গেলে পরে একটি নদী । সত্যি জায়গাটি অপূর্ব আমরা সারাটা দিন এদিক-সেদিক ঘুরে কাটালাম এই গ্রামের মানুষ যেন ভীষণ ভালো, তাদের সাথে মিশতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগলো না ।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । গ্রামের লোকজনদেরকে বললাম আমরা এখানে ক্যাম্পিং করব তারা আমাদেরকে একটি জায়গা দেখিয়ে দিলেন।
এখানটায় তোমরা করতে পারো কোন অসুবিধা হবে না।
সে কথা অনুযায়ী আমরা সেখানে টেন্ট খাটালাম। প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত বোন ফায়ার হল আমাদের তারপরে সবাইকে যার মত ঘুমিয়ে গেলাম।
খুব সকালে আমার ঘুম ভেঙে গেল ,উঠে দেখি সবে সাড়ে পাঁচটা বাজছে নিজের উপর বিরক্ত হলাম। একে তো অর্ধেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম তারপর আবার এত সকালে ঘুম ভেঙে গেল তারপর আর ঘুমটাও ধরল না । সেসব ভেবে একটু বাইরে বেরোলাম টেন্ট থেকে। কিন্তু বেরোনোর পর নিজে নিজেকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করলো চারিদিকে কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে চারিদিকে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছে । আমি কোন রকমে টেন্ট থেকে রেডি হয়ে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ।
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছি সেই গ্রামটাতে আমরা ছিলাম তার থেকে অনেকটা দূরে এখানে দেখছি এখানেও কিছুটা লোকালয় দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ আমার নাকে খাবারের তীব্র গন্ধ আসলো। আমি সেদিকে যেতে লাগলাম । গিয়ে দেখলাম একটি মাটির ঝুপড়ির মতো দোকান সেখানে চা এবং কচুরি বিক্রি হচ্ছে । চা আর কচুরি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। যতই হোক বাঙালি তো । গেলাম সে দোকানটার উদ্দেশ্যে।
আমি :কাকু এক প্লেট কচুরি এবং চা দিন তো ।
কাকু টি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন জায়গায় কি নতুন ?
আমি :হ্যাঁ কাকু। কালকে আমার সব বন্ধুরা মিলে বেড়াতে এসেছি, সকালে আপনার খাবারের গন্ধ পেয়ে এদিকে চলে আসলাম।
কাকুটি বললেন তুমি বসো আমি তোমাকে খাবার দিচ্ছি।
আমি বসে গেলাম একটি বেঞ্চের উপর। আমার পাশে এসে বসলো একটি মেয়ে হয়তো 12 কি 13 বছর বয়স হবে? মেয়েটা দেখতে ভীষণ মিষ্টি ।
আমার পাশে বসে বলল “দিদি নাকি এখানে বেড়াতে এসেছেন ?”
আমি : হ্যাঁ ।
সে আমার পাশে বসে অনেক গল্প করতে লাগল। দেখেই বুঝতে পারলাম মেয়েটার ভীষণ মিশুকে। ইতিমধ্যেই কাকু খাবার নিয়ে চলে এসেছেন আমি সব ভুলে খেতে শুরু করলাম। সত্যি কি অপূর্ব স্বাদ এর আগে কখনো এত সুন্দর খাবার খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না ।
আমি খাবারগুলো শেষ করে উঠছিলাম তখনই দেখলাম দুজন গুন্ডার মতো দেখতে লোক এসেছে দোকানের সামনে দাঁড়ালো এবং কাকুকে বলতে শুরু করল ” টাকা বার করো ভাই পাঠিয়েছে।”
কাকু তখন বলে উঠলো “আমি নিজের কষ্টের রোজগারের টাকা তোমাদের ভাইকে দিতে পারব না যাও তাকে বলে দাও । “
তখন সেই লোকটি হেসে বলল “তোমাকে তো দিতেই হবে। ভাইয়ের হুকুম আছে না দিলে সোজা মেরে ওপরে পাঠিয়ে দিতে। “
তখনই কাকুর স্ত্রী হাতে বটি নিয়ে বেরিয়ে এলেন “তোমরা প্রতি সপ্তাহে পেয়েছো কি আমাদের কষ্টের টাকা তোমাদেরকে আমরা কেন দেবো”।
এই কথা শোনার পর লোক দুটি ভীষণ রেগে গেল এবং তাদের দিকে এগিয়ে গেল একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সেই লোকটি কাকু এবং তার স্ত্রীর পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিলেন। সেই মেয়েটি বাবা বলে চিৎকার করে তাদের কাছে গেল ছড়ানোর জন্য কিন্তু সেই লোকটি সে মেয়েটিরও পেটে ছুটে ঢুকিয়ে দিল ,এবং তিনজন আমার সামনে পড়ে রইলো মাটিতে। সেই লোক দুটি চলে গেল।
আমি এতক্ষন স্তম্ভিত ভাবে দেখে চলেছিলাম সবটা ,কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে আমার অনেকটা সময় চলে গেল। হঠাৎ দেখলাম সেই মেয়েটি পা দুটি আঁকড়ে ধরল।
আমি সেদিকে তাকাতেই সেই মেয়েটি বলে উঠলো “দিদি আমাদের প্রতি অন্যায়ের শাস্তি আপনি তাকে দেবেন “
আমি : কি করে আমি সেই মানুষগুলোকে চিনিও না ।
সে বলল আমাকে ২০২১ সালে অক্টোবরের খবরের কাগজটি দেখবেন আপনার সব উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন । সেখানেই হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম যেখানে তার হাতটি ছিল সেটি বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে রয়েছে যেন কোনো মৃত দেহ আমাকে স্পর্শ করে রয়েছে । আমি ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলে, দেখতে পেলাম সেই তিনটি লাশ পঁচে গলে বীভৎস আকার ধারণ করেছে। আমি ভয় পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ সেই বাড়ির দেয়ালে দেখলাম এ কি এতো সেই মহিলাটির ছবিটা, যিনি আমাদেরকে এখানে আসার জন্য বলেছিলে ।
সেটা দেখে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো । চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল । একটা সময় সেখানেই জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলাম আমি আমার টেন্টের ভিতর রয়েছি এবং আমার সব বন্ধুরা আমাকে ঘিরে রয়েছে।
আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলাম।
আমি: আমি এখানে কি করছি আমি তো ..আমি তো সেই বাড়িটির ওখানে ছিলাম কাকু কাকিমা এবং তার মেয়েকে আমার চোখের সামনে মেরে ফেললো তারা আমি কিছু করতে পারলাম না ।
আহিল :কি সব বাজে বকছিস কোথায় লাশ কে কাকে মেরেছে আমিতো গিয়ে দেখলাম তুই একটি লোকালয়ে একদিকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছিস তাই তোকে এখানে নিয়ে এসেছি আমরা।
আমার তখন মনে পড়ল সেই মেয়েটির বলার কথা। ২০২১ সালে অক্টোবরের খবরের কাগজটি অনেক কষ্টের জোগাড় করলাম ,এবং দেখলাম সেখানে লেখা আছে এলাকার ভাইকে সাপ্তাহিক চাঁদা না দেওয়ার কারণে একটি পুরো ফ্যামিলি মৃত্যু ঘটলো।
আমি এবং আমার বন্ধুরা বাড়ি ফিরে এলাম তারপরে পুলিশদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে জেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।
নিজের বাড়ির বারান্দার ডিভানে বসে রয়েছি হাতে কফির মগটা থেকে ধোয়া উঠছে । গত দুই বছর হয়ে গেল ঘটনাটি তাও যেন মনে হচ্ছে সবকিছুই আমার চোখে জীবন্ত। হয়তো কখনো এই ঘটনা ভুলতে পারবো না। সারা জীবন আমার মস্তিষ্কে একটি জীবন্ত স্মৃতি হয়ে কাটিয়ে দেবে। এসব ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।