ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে আমরা সব সময় তাজমহলকে চিনি, কিন্তু বাস্তবিক ভালোবাসার যে কত গভীর নিদর্শন থাকতে পারে, তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। তাজমহল প্রেমের প্রতীক হিসেবে বিশ্বে খ্যাত, কিন্তু ভারতের মাটিতে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তার জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে তার প্রিয়তম স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক সেই প্রকৃত ভালোবাসার গল্প।
১৮৯৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ভালোবাসা দিবসে, দোরাবজি টাটা এবং মেহেরবাঈ-এর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দোরাবজি ছিলেন ভারতীয় শিল্পপতি এবং টাটা গ্রুপের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। মেহেরবাঈ ছিলেন খুবই সুন্দরী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী। তার ব্যক্তিত্বে রাজকীয় ভাবের ছাপ ছিল, যা তাকে সকলের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলে। তিনি ভারতীয় শাড়ি পরেই বিশ্বের সব ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতেন, এবং তিনি ছিলেন একজন চমৎকার টেনিস খেলোয়াড়।
যে কোনো ডাক্তার বাবু ফ্রী তে বুকিং করার জন্য ক্লিক করুন DrBooking
বিয়ের দুবছর পর, তাদের বিবাহবার্ষিকীতে, দোরাবজি তার স্ত্রী মেহেরবাঈকে একটি অসাধারণ হিরে উপহার দেন। এই হিরেটি ছিল ২৪৫ ক্যারেটের, যা আকারে বিশ্ববিখ্যাত কোহিনূরের দ্বিগুণ ছিল। এর বর্তমান মূল্য প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। স্বামীর কাছ থেকে এমন একটি মূল্যবান উপহার পেয়ে মেহেরবাঈ অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এই হিরের গুরুত্ব আরও বেশি হয়ে দাঁড়ায় যখন এটি টাটা গ্রুপের অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্বযুদ্ধের পর, টাটা গ্রুপের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে দোরাবজি টাটার কাছে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার মতো অর্থও ছিল না। কোম্পানি প্রায় বন্ধ হতে শুরু করে। এই কঠিন সময়ে, মেহেরবাঈ তার স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে পরামর্শ দেন তার উপহারের হিরে এবং অন্যান্য মূল্যবান গহনাগুলো বন্ধক দিয়ে ঋণ নিতে। প্রথমে দোরাবজি রাজি না হলেও, শ্রমিকদের কথা ভেবে তিনি তার স্ত্রীর পরামর্শ মেনে নেন এবং এক কোটি টাকা ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন মেটানোর ব্যবস্থা করেন। এই ঋণের অর্থ দিয়েই টাটা ইস্পাত কারখানা আবার নতুন করে চালু হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যবসা ফিরে আসে আগের রমরমা অবস্থায়।
কিন্তু ১৯৩১ সালে, মেহেরবাঈ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসায় ধরা পড়ে যে তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। দোরাবজি তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখান, কিন্তু কেউই তাকে সুস্থ করতে পারেননি। অবশেষে, মেহেরবাঈ ১৯৩১ সালে এক নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে দোরাবজি এতটাই ভেঙে পড়েন যে তিনি এর এক বছর পর, ১৯৩২ সালের ৩রা জুন, মারা যান।
তবে মারা যাওয়ার আগে, দোরাবজি তার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতিতে রেখে যান ভারতের মাটিতে ভালোবাসার এক চিরন্তন প্রতীক। স্ত্রীর মৃত্যু তাকে কষ্ট দিলেও, তিনি তার ভালবাসাকে অমর করতে চেয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে, তিনি মেহেরবাঈ-এর উপহারের হিরে বিক্রি করে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল এবং লেডি টাটা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গড়ে তোলেন। এই হাসপাতালটি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ভারতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর একটি হয়ে ওঠে। প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ এর ও বেশি মানুষ ক্যান্সার এর বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশ থেকেও রোগীরা আসেন। হাসপাতালের বিভিন্ন শাখায় প্রতি মাসে কয়েক হাজার শিশু ক্যান্সার রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। ভারতের বিভিন্ন স্থানে টাটা মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যেমন কলকাতা, ভুবনেশ্বর, বারানসি, তিরুপতি, রাঁচি এবং উত্তর প্রদেশ। ভারত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতায় তেলেঙ্গানা, আসাম, ওড়িশা, নাগাল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সারের গবেষণা কেন্দ্র এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে।
তাজমহল তৈরির পর, বলা হয়, শাহজাহান শ্রমিকদের আঙুল কেটে দিয়েছিলেন যাতে তাজমহলের মতো আর কোনো স্থাপত্য না তৈরি হয়। কিন্তু দোরাবজি টাটা মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন, তার ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সারা দেশে আরও অনেক হাসপাতাল গড়ে উঠুক, যেখানে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা পেতে পারে। দোরাবজি এবং মেহেরবাঈ-এর এই ভালোবাসার কাহিনী যেন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে না যায়, বরং তা আমাদের মনে এক অনন্ত ভালোবাসার উদাহরণ হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকে।
যে কোনো ডাক্তার বাবু ফ্রী তে বুকিং করার জন্য ক্লিক করুন DrBooking
টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৯২ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা টাটা গ্রুপ থেকে এমন ওষুধও পেতে পারি, যা ক্যান্সার সারাতে সক্ষম হবে। এটাই প্রকৃত ভালোবাসার নিদর্শন, যা সময়ের সাথে সাথে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
One Response
Kemon laglo pore janan