ঘাটাল, অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী মহকুমা শহর। যদিও এই শহরে নগর পরিষেবা নেই, তবুও এটি অনেক পুরনো এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ঘাটাল শহরের প্রাণ শিলাবতী নদী, যা ভারি বর্ষার সময় কখনও কখনও বন্যার সৃষ্টি করে স্থানীয়দের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইংরেজ শাসনামলে, যখন রেলগাড়ি এবং যান্ত্রিক যানবাহন ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না, তখন কলকাতা, হাওড়া, হুগলী জেলা এবং ঘাটাল সহ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল শিলাবতী নদী। শিলাবতী নদী, দ্বারকেশ্বরের শাখা নদী ঝুমী নদীর সঙ্গে মিশে প্রশস্ত হয়ে রূপনারায়ণ নামে পরিচিত হয়। রূপনারায়ণ নদী রানীচক, কোলাঘাট এবং তমলুক হয়ে গেঁওখালিতে হুগলী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।
হুগলী-রূপনারায়ণ-শিলাবতী নদী ছিল প্রধান পরিবহন পথ। এ পথে কলকাতা থেকে প্রয়োজনীয় মালপত্র আমদানি এবং ঘাটাল ও তার পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি করা হত। নৌকা, পানসি এবং স্টিমার ব্যবহার করে পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন করা হত। শিলাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বিদেশিদের আস্তানা, যা ঘাটালের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ আমলে ঘাটাল স্টীম নেভিগেশান কোম্পানীর স্টীমার ও লঞ্চ চলতো, যা পরবর্তীকালে হোরমিলার কোম্পানীর স্টীমার ও লঞ্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও লঞ্চ ব্যবহার চলতে থাকে এবং নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত ঘাটাল থেকে লঞ্চ চলাচল করত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭ শতকের মধ্যভাগে বাংলায় রেশম কারখানা খোলার অনুমতি পায় এবং মেদিনীপুরের রেশম ও সূক্ষ্ম মসলিনের বাণিজ্য শুরু করে। রেশম শিল্প ও নীল চাষের উৎকর্ষতা ব্রিটিশ আমলের অনেক আগে থেকেই ঘাটাল এলাকায় প্রসার লাভ করে। বিভিন্ন স্থানে রেশমকুঠি গড়ে ওঠে এবং আজও সেইসব কুঠির ধ্বংসাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে।
১৮৭৬ সালে হান্টার সাহেব যখন স্টাটিস্টিক্যাল একাউন্ট অফ বেঙ্গল সংকলন করেন, তখন বড় শিল্প ছিল না। ঘাটাল, রেশম, সুতী ও নীল বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। ঘাটালের ব্যবসায়ী পরেশচন্দ্র ভুঁইয়া ও তার জ্ঞাতিগণ ঘাটালের বিভিন্ন জায়গায় কুঠি স্থাপন করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তার সময়কালে ঘাটাল অঞ্চলে তার কিছু কাজের কারণে তিনি ওই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। ভাসাপুলের সাথে তার সংযোগের গল্পগুলি স্থানীয় লোককথার অংশ হতে পারে, যা তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রতিফলন।
শোনা যায় যে পন্ডিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাসাপুলের উপর দিয়ে পারাপার করার অনুমতি ছিল। স্বদেশী আন্দোলন ও শিল্প বিপ্লবের পর ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শিল্পে ভাটা পড়ে এবং ডাচরা ধীরে ধীরে বাণিজ্যে সংকোচন ঘটায়। ইংরেজদের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তারা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। তারই ফল হিসেবে বেঙ্গল ফেরী এ্যাক্ট ১৮৮৫ এর ৬নং ধারামোতাবেক, ১৯০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, পুলটি সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। স্বাধীনতা লাভের প্রায় তেরো বছর পর, ১৯৬০ সালে শিলাবতী নদীর উপর আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু নির্মাণ করা হয় যা ভাসাপুলের চাপ কমিয়েছে। যদিও এর উপযোগিতা নিয়ে আজ প্রশ্ন থাকতে পারে, ঘাটাল বললে প্রথমেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠে ভাসাপুল।
শিলাবতী নদীর ওপর তৈরি ভাসাপুল, যা আজও ঘাটাল শহরের ঐতিহ্যের প্রতীক। এই পুলটি অনেকবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুনটুন ব্রিজ নামে পরিচিত এই পুলটি মকরসংক্রান্তির দিনে একটি ছোট মেলার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে ভাসাপুল রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এই ভাসাপুলের নানা ঐতিহ্য, আবেগ, ইতিহাসের সাক্ষী | এই ভাসাপুল অনেক বার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর একটা পোশাকি নাম আছে পুনটুন ব্রিজ। প্রতিবছর মকরসংক্রান্তির দিন এই ভাসাপুলকে কেন্দ্র করেই গ্রাম্য জিনিস পত্র কেনাবেচা হয়। ঘাটালবাসীর কাছে ভাসাপুল গা-সওয়া হলেও রাজ্যবাসীর কাছে বড়োই বিস্ময়ের।
ঘাটাল পুরসভা ভাসাপুলের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং বিভিন্ন দিনে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ভাসাপুলকে পর্যটন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় হেরিটেজ কমিশন এটিকে হেরিটেজের মর্যাদা দেয়। ঘাটালের ঐতিহ্যশালী এই নিদর্শনটি দিনের পর দিন আমাদের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকুক।