কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি “বিদ্রোহী কবি” নামে পরিচিত, তাঁর সৃজনশীল কর্মে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার এক অবিশ্বাস্য মেলবন্ধন দেখা যায়। “বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শোখাতে দিসনে আজ এ ডাল” গানটি তার জীবনের একটি অত্যন্ত করুণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যা তার সৃজনশীল অভিব্যক্তিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
এই গানটি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনসঙ্গিনী প্রমীলা দেবীর অকাল মৃত্যু পরবর্তী সময়ে রচিত হয়েছিল। তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত কোমল ও শক্তিশালী ছিল, যা নজরুলের সৃষ্টির অন্যতম প্রধান প্রেরণা। প্রমীলা দেবী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন, এবং তার এই দীর্ঘ রোগভোগ নজরুলের জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই গানের কথায় এক শোকাতুর হৃদয়ের আকুতি প্রতিফলিত হয়, যেখানে রোমান্টিকতা এবং আধ্যাত্মিক উর্ধ্বতা মিলেমিশে আছে, যা নজরুলের শিল্পকলার পরিচয় বহন করে।
গানের কথায় বুলবুলির ফুলের ডালে বসতে দ্বিধা প্রকাশ একটি গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করে। এটি জীবনের সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং নশ্বরতা তুলে ধরে। বুলবুলি পাখি, যা সাহিত্যে প্রেম, আকুতি এবং কবিতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, নজরুলের এই গানে জীবনের ফ্রাজিলিটি এবং সেই সৌন্দর্যকে ছোঁয়ার লড়াইয়ের প্রতিফলন হতে পারে।
কাজী নজরুল ইসলাম এমন একজন কবি ছিলেন যার জীবন শোক এবং সাহসের চিহ্ন বহন করেছিল। তার স্ত্রীর মৃত্যু ছিল একমাত্র শোক নয়; এর আগেও তিনি তার সন্তান বুলবুলকে হারিয়েছিলেন। এটি ছিল তার জীবনের এক অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা তার সৃজনশীলতায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তার সন্তানকে বুলবুলি নামে ডাকতেন, এবং এই প্রতীকটির প্রতি তার এক বিশেষ মমত্ববোধ ছিল। সম্ভবত, এই গানে বুলবুলি পাখির ইঙ্গিত তার সন্তানের স্মৃতির প্রতি এক সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন যেন দুঃখ-সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল। তাঁর এই গানটির সৃষ্টি হয়েছিল এক ভীষণ শোক এবং দারিদ্র্যের অন্ধকার পরিবেশে। কবির ছোট ছেলে, বুলবুল, অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু অর্থাভাবে কবি তাঁর ছেলের সঠিক চিকিৎসা করাতে পারলেন না। বুলবুল তখন ছিল কবির হৃদয়ের একান্ত প্রিয়, যাকে তিনি তাঁর জীবনের ফুল বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু সেই প্রিয় সন্তান বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, যা নজরুলকে গভীর শোকগ্রস্ত করে তোলে।
এই শোকের মধ্যে, নজরুলকে আরেকটি চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর কাছে ছেলের শেষকৃত্যের জন্যও পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। তিনি যখন সাহায্যের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন, তখন কেউ তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না। নজরুল, যিনি বহু গান, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে মানুষের মনে সাহস ও প্রেমের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন, নিজে এমন অসহায় অবস্থায় পড়বেন তা হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি।
শেষমেশ তিনি এক প্রকাশকের কাছে গেলেন, যিনি আগে নজরুলের কিছু কাজ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রকাশককে জানালেন যে তাঁর ছেলে মারা গেছে এবং ছেলের দাহকার্যের জন্য ১৫০ টাকা প্রয়োজন। নজরুল এই টাকা ধার হিসেবে চাইলেন এবং বিনিময়ে যা কিছু করতে হবে তাতে তিনি রাজি ছিলেন।
তখন প্রকাশক নজরুলকে বললেন, তিনি সরাসরি টাকা ধার দেবেন না। তবে, যদি নজরুল সেই মুহূর্তে একটি গান লিখে দিতে পারেন, তবে তিনি সেই গানটির জন্য ১৫০ টাকা দিতে প্রস্তুত। এই প্রস্তাব শোনার পর নজরুল, একজন শোকাকুল পিতা হিসেবে, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। হৃদয়ের গভীর দুঃখ আর হতাশার সঙ্গে তিনি কলম ধরলেন।
নজরুলের মনের শোক ও দুঃখ তখন কলমের কালিতে রূপ নিল। বুলবুলের স্মৃতিকে উৎসর্গ করে তিনি লিখলেন “বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি একবার দল”। এই গানটি যেন তাঁর হৃদয়ের গভীর যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। বুলবুলি পাখির মাধ্যমে তিনি তাঁর মৃত সন্তানের জন্য অনুভূত শূন্যতা এবং ভালোবাসার আবেগ প্রকাশ করেন।
গানটি লেখা শেষ করার পর, প্রকাশক নজরুলকে প্রতিশ্রুত টাকা প্রদান করেন। সেই অর্থ নিয়ে কবি ছুটে যান তাঁর ছেলের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে। এ ঘটনা শুধু নজরুলের জীবনের এক করুণ অধ্যায় নয়, বরং এটি তার সৃষ্টিশীলতার সেই অমোঘ শক্তিকে তুলে ধরে যা তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখকে সার্বজনীন শোকের রূপ দেয়।
এই ঘটনা আমাদের নজরুলের মনুষ্যত্ব এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাঁর এই করুণ অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এমন এক গান, যা আজও আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে।
One Response
Darun…
kothagulo age theke jantam…
but porte khub valo laglo….