প্রোফেসর শঙ্কু, সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট এক অবিস্মরণীয় চরিত্র, বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির এই নায়ক তার প্রতিভা, অনুসন্ধানী মনোভাব এবং দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। প্রোফেসর শঙ্কুর প্রতি বাঙালি পাঠকের আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে কিছু বিশদ.
প্রোফেসর শঙ্কু, যার পূর্ণ নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু, হলেন সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক চরিত্র। তিনি একজন প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক এবং উদ্ভাবক, যার অসাধারণ মেধা এবং বিচিত্র আবিষ্কারগুলি তাকে একটি অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তার চরিত্র প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬১ সালে, ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় “ব্যোমযাত্রীর ডায়রি” গল্পের মাধ্যমে।
প্রোফেসর শঙ্কুর প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
প্রোফেসর শঙ্কুর জন্ম গিরিডিতে। তাঁর পিতার নাম ত্রিপুরেশ্বর, যিনি একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। শঙ্কুর জন্মদিন ১৬ জুন (একটি ডায়রিতে অবশ্য ১৬ অক্টোবর উল্লেখ আছে)। শঙ্কু খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন, ১৪ বছর বয়সে আইএসসি এবং ১৬ বছর বয়সে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে অনার্সসহ বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। কুড়ি বছর বয়সে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
চেহারা ও ব্যক্তিগত জীবন
প্রোফেসর শঙ্কুর চেহারা বেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তেরো বছর বয়সে তার মাথায় প্রথম পাকাচুল দেখা যায়, সতেরো বছর বয়সে টাক পড়া শুরু হয় এবং একুশ বছর বয়সে মাথার বেশিরভাগ অংশই টাক হয়ে যায়। তিনি তার গৃহে প্রহ্লাদ নামের একজন চাকর এবং নিউটন নামের একটি পোষা বিড়ালসহ থাকেন।
বৈজ্ঞানিক মেধা ও আবিষ্কার
শঙ্কু বিশ্বে তার নামডাক অর্জন করেন মূলত আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক হিসেবে। তার মোট ৪০টি ডায়রিতে ধরা আছে তার ৭২টি আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা। তার আবিষ্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হল মিরাকিউরল, এয়ারকন্ডিশনিং পিল, বটিকা ইন্ডিকা, তৃষ্ণাশক বড়ি, সন্মোলিন, নার্ভিগার, সেরিব্রিলান্ট, নার্ভাইটা, এভলিউটিন, এবং অদৃশ্য হওয়ার বড়ি।
শঙ্কুর দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ
প্রোফেসর শঙ্কু মুক্তমনা এবং বিজ্ঞানমনস্ক। তিনি কোনও কিছুকেই চোখ বুজে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করেন না। তিনি সত্য অনুসন্ধানের জন্য সব সময় উদ্যমী এবং যুক্তিবাদী। মানবতার প্রতি তার অবিচল বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা তার গবেষণা ও আবিষ্কারের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
উল্লেখযোগ্য অভিযান ও চরিত্র
শঙ্কুর বিভিন্ন অভিযানে তার বৈজ্ঞানিক মেধার প্রয়োগ দেখা যায়। তার গল্পগুলোতে সন্ডার্স, ক্রোল, নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ বন্ধু এবং সহযোগীদের সঙ্গে তার সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। শঙ্কু তার প্রতিটি অভিযানই তার প্রিয় ওয়াটারম্যান কলমে লেখেন। তার ডায়রির পাতাগুলি অদ্ভুতভাবে অবিনশ্বর, যা আগুনে পোড়ে না, ছেঁড়ে না, এবং কুকুরের কামড়েও অক্ষত থাকে।
সন্দেশের ভার হাতে নেওয়ার পর পাঠকদের দাবি মেটাতেই কলম ধরেন সত্যজিৎ। ফেলুদা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে (প্রকাশ ১৯৬৫), তার প্রায় চার বছর আগেই সেপ্টেম্বর ১৯৬১-তেই প্রফেসর শঙ্কুর আবির্ভাব। গল্পের নাম ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। পরবর্তীকালে সত্যজিৎও জানিয়েছেন যে আর্থার কোনান ডয়েল রচিত প্রফেসর চ্যালেঞ্জার চরিত্রটির স্পষ্ট প্রভাব ছিল শঙ্কুর উপর। কিংবা হয়তো শুধু তা-ই নয়। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রিতে’ শঙ্কুর গবেষণা নিধিরাম পাটকেলের মতো, আর তার অ্যাডভেঞ্চারে হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ছোঁয়া বর্তমান।
তবে শম্ভুর বিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে। স্থিতধী, সৌম্য, প্রাজ্ঞ, ঋষিতুল্য শঙ্কু আবির্ভূত হন। প্রফেসর শঙ্কুর জীবনের কালানুক্রম বজায় রাখা বেশ শক্ত। তার ৩১ বছরের ৪০ টি ডায়রিতে ধরা আছে তাঁর ৭২টি আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা। মজার ব্যাপার হল, তাঁর আবিষ্কারের মধ্যে ২০টি ওষুধ বা বড়ি। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মিরাকিউরল। এছাড়াও আছে এয়ারকন্ডিশনিং পিল, বটিকা ইন্ডিকা, তৃষ্ণাশক বড়ি, টি-পিল, কফি-পিল, সন্মোলিন, নার্ভিগার, সেরিব্রিলান্ট, নার্ভাইটা, এভলিউটিন, ঘ্রাণশক্তি বৃদ্ধির ওষুধ, অদৃশ্য হওয়ার বড়ি ইত্যাদি।
শঙ্কুর পোষা বিড়াল নিউটনের জন্য ফিস পিল আর পোষা কাক কর্ভাসের জন্য মুখরোচক বড়িও প্রস্তুত করেছেন তিনি। ‘গোলক রহস্য’-এ অ্যানাইহিলিন বড়ি উল্লেখিত আছে, যদিও তার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট নয়। শঙ্কুর বিজ্ঞানীসুলভ মজাদার চরিত্র এবং মানবতা সব সময়ই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
শঙ্কু বিশ্বাস করেন মুক্তমনাতে। অবিনাশবাবুর মতো পড়শি, মাকড়দাবাসী নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস, বিদেশি বন্ধু সন্ডার্স আর ক্রোলসহ শঙ্কুর প্রতিটি অভিযানই তাঁর প্রিয় ওয়াটারম্যান কলমে লেখা। ডায়রির পাতা অদ্ভুতভাবে অবিনশ্বর এবং তাঁর বন্ধুত্বও সেই রকম।
প্রফেসর শঙ্কুর জীবনচর্যা থেকে শঙ্কুর বাবার উপদেশ যেন গোটা শঙ্কু কাহিনির হৃদয়স্পন্দন হয়ে ওঠে: “যে ভাবেই রোজগার করিস না কেন, যারা দরিদ্র, যারা নিরক্ষর, যারা মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, তাদের কথা ভুলিস না।
প্রোফেসর শঙ্কুর গুরুত্ব
প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রটি শুধুমাত্র বাঙালি সাহিত্যে নয়, সারা বিশ্বের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জগতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট এই চরিত্রটি বিজ্ঞানমনস্ক কিশোরদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ও গবেষণার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করে। শঙ্কুর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিজ্ঞানের প্রতি তার নিরলস অনুরাগ তাকে একটি প্রেরণাদায়ক চরিত্রে পরিণত করেছে।
প্রথম গল্প যেখানে শঙ্কুর সাথে পরিচয় হয়। তিনি টাফা নামক গ্রহে ভ্রমণ করেন এবং অজানা এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
শঙ্কু তার বিভিন্ন আবিষ্কারের নোট রাখেন। এই গল্পে তার জীবনের কিছু অংশ এবং গবেষণার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
একটি বিশেষ ধরনের ওয়াকিটকি আবিষ্কার করেন যা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।
শঙ্কু একটি এমন ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করেন যা ভবিষ্যতের ঘটনা সম্পর্কে জানাতে পারে।
শঙ্কু এমন এক বিস্ফোরক আবিষ্কার করেন যা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ব্যবহৃত হতে পারে।
শঙ্কু ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার নিজের একটি ক্লোন তৈরি করেন।
শঙ্কু সময় ভ্রমণ করতে সক্ষম এমন একটি মেশিন আবিষ্কার করেন।
শঙ্কুর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, মিরাকিউরল বড়ি, যা সব ধরনের রোগ সারাতে সক্ষম।
এই গল্পে শঙ্কু জীবিত এবং মৃতদের নিয়ে গবেষণা করেন এবং এক বিশেষ ধরনের হাড়ের গঠন আবিষ্কার করেন।
শঙ্কু রোবু নামের একটি রোবট তৈরি করেন, যা বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম।
শঙ্কু এমন এক ব্যক্তি তৈরি করেন যার শরীরে চুম্বকীয় ক্ষমতা রয়েছে।
শঙ্কু মিশরে একটি রহস্যময় অভিশাপের তদন্ত করতে যান এবং একটি পুরনো পিরামিডে ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
শঙ্কু কঙ্গোতে এক অভিযানে যান যেখানে তিনি প্রাচীন উপজাতি এবং তাদের রহস্যময় ধ্যানধারণার সম্মুখীন হন।
শঙ্কু মনরো দ্বীপে এক রহস্যময় প্রাণীর সন্ধানে যান এবং নানা অজানা ঘটনার মুখোমুখি হন।
শঙ্কু একটি ইউএফও এবং এলিয়েনদের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন।
শঙ্কু একটি ছোট্ট ছেলের সাথে মিলে একটি বিশেষ অভিযান সম্পন্ন করেন।
শঙ্কু একটি বিশেষ ধরনের গ্যাস আবিষ্কার করেন যা হিপনোসিস সৃষ্টি করতে সক্ষম।
শঙ্কু এমন একটি পিল আবিষ্কার করেন যা খেলে স্নোর বন্ধ করা যায়।
শঙ্কু এক প্রাচীন ড্রাগনের রহস্য উদঘাটন করতে চীনে যান।
শঙ্কু এমন একটি কলম আবিষ্কার করেন যা দিয়ে লেখা কোনোভাবেই মুছে ফেলা যায় না।
শঙ্কু মঙ্গল গ্রহে একটি অভিযান পরিচালনা করেন।
শঙ্কু এমন একটি প্রিজম আবিষ্কার করেন যা দিয়ে বিভিন্ন আলোক রশ্মির রঙ পরিবর্তন করা যায়।
শঙ্কু একটি সুপার কম্পিউটার তৈরি করেন যা পৃথিবীর যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
শঙ্কু ভৌতিক ঘটনার গবেষণা করেন এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা খোঁজেন।
শঙ্কু প্রাচীন হাড়ের রহস্য উদঘাটন করেন।
শঙ্কু মিশরে নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি এবং তার অভিশাপের রহস্য উদঘাটন করতে যান।
শঙ্কুর শেষ অভিযান যেখানে তিনি একটি বিশেষ ধরনের গাছের পাতা আবিষ্কার করেন, যা অমরত্ব দিতে পারে।
প্রোফেসর শঙ্কুর অভিযানের এই তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তার বৈজ্ঞানিক মেধা, বিচিত্র আবিষ্কার এবং অসাধারণ দুঃসাহসিকতার পরিচয় বহন করে। এসব অভিযান তাকে বাংলা সাহিত্যের এক অমর চরিত্রে পরিণত করেছে।
প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রটি বাঙালি পাঠকদের মধ্যে যে আবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টি করেছে তা অবর্ণনীয়। তার প্রতিটি অভিযান, প্রতিটি আবিষ্কার পাঠকদের মধ্যে অমোঘ প্রভাব ফেলেছে। শঙ্কুর প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা শুধু বাঙালি পাঠকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রোফেসর শঙ্কু এবং তার কাহিনিগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পাঠকদের মুগ্ধ করে চলেছে। সত্যজিৎ রায়ের এই অসামান্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে এবং তা চিরকাল থাকবে।